
এক হাতে যাঁর রঙের তুলি আর হাতে গীতিবাদ্য
রাজ চক্রবর্তী
বাঙালির ব্যক্তিত্ব ও মনীষা দিকে দিকে স্মরণীয়তার স্বাক্ষর রেখেছে, ইতিহাস তার সাক্ষী। উনিশ-বিশ শতক ছিল এদিক দিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যক্তি নয়, গোটা পরিবারই স্বমহিমায় উজ্জ্বল৷ আজ এই কলমে এমনই এক পরিবারের কথা৷ বাংলায় রায় ও ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস সকলেরই জানা৷ আজ এমন একটি ব্যক্তি তথা পরিবারের কথা আলোচ্য যে-পরিবারের পদবিটাই কৃতিত্বের বিনিময়ে পাওয়া।
অন্নদা মুন্সি। আঠারো শতকে এই বংশের আদি পদবি ছিল দাস। কালক্রমে তাদের উপাধি জুটল মজুমদার৷ আরও পরে কর্মে মুন্সিয়ানার ফলস্বরূপ তারা উপাধি পেয়েছিলেন মুন্সি৷ আজও তারা সেই পদবিটাই নামের পাশে ব্যবহার করেন। এই পরিবারের সন্তানরা দিকে দিকে তাদের মুন্সিয়ানার পরম্পরা অব্যাহত রেখেছেন। অন্নদা মুন্সি এই পরিবারেরই শ্রেষ্ঠ পুরুষ।
একইসঙ্গে চিত্র ও বাদ্যশিল্পে অন্নদা মুন্সির প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল৷ আর এরই সাহায্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিজ্ঞাপন জগতের কৃতী শিল্পী। পদ্মাপারের পাবনার শিবনগরের চৌগাছা গ্রামে ১৯০৫ সালের ২৭ নভেম্বর তাঁর জন্ম। বাবা অনুকূলচরণ জমিদারবংশের ধারক হলেও শিল্পীমন লালিত হত তাঁর ভিতরে। নিজে ছিলেন সে-যুগের নামকরা ঝিনুক-শিল্পী। তাঁরই দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম সন্তান অন্নদা। কম বয়সে বাবার কাছেই হাতের কাজের তালিম পেয়েছিলেন। পরে কলকাতায় এসে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে হলেন অন্নদা। শিল্পকলা ছাড়াও ছোট থেকেই অন্নদার ঝোঁক ছিল ফুটবল, সাঁতার আর সংগীতচর্চায় ভাল ঘোড়সওয়ারও ছিলেন৷ চণ্ডীমন্ডপের এক কোণে নিরালায় বসে আপন মনে পুতুল গড়ে সময় কাটাতে ভালবাসতেন। বাবার সঙ্গে ঝিনুক শিল্প নিয়ে হরিহর ছত্রের মেলায় যেতেন।
আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর অন্নদা শিল্পী হিসাবেই কলকাতার এক কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। নজরে পড়ে গেলেন অনেকের৷ তারপর বম্বের টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় যোগ দেন৷ পাঁচ বছর পর (১৯৩৫) যোগ দিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা জে. ডি. কিমারে প্রধান শিল্পী হিসাবে৷ বারো বছর একটানা এই সংস্থায় তিনি কাজ করেন এবং এখানেই তার শিল্পীজীবনের সিদ্ধিলাভ। বিজ্ঞাপন বিষয়ক প্রচারচিত্রে অন্নদা মুন্সির সমতুল শিল্পী এদেশে বিরল। ‘রেলওয়ে’ আর “টি-বোর্ড’-এর দু’টি বিজ্ঞাপন তাকে চটপট খ্যাতির শিখরে তুলেছিল৷ সে সময় সারা ভারতে তিনিই একমাত্র শিল্পী যিনি লে-আউটের জাদু জানতেন৷ জে ডি কিমারের এইচ উইলিয়াম অন্নদার কাজে উদ্ভাবনী চিন্তার ছাপ দেখে তাঁকে ভিসুয়ালাইজারের চাকরি দিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসেন৷ এখানেই পরে তার কাছে কাজ শিখেছিলেন শিল্পী সত্যজিৎত রায়৷ সত্যজিৎ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমি মোটামুটি বলতে গেলে লে আউট করার কাজটা তার কাছেই শিখেছি৷ একরকম হাতেখড়ি তাঁর কাছেই হয়েছে।’’ (১৮/৪/১৯৮৭ তারিখে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার)
অন্নদা মুন্সির ছবিতে আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব ছিল৷ কিন্তু সস্তায় হাততালি কুড়োবার লোভে তাঁকে কোনওদিন নিজ বা পর ধর্মের দেবদেবী বা প্রফেটদের বিকৃত ছবি আঁকার পথ ধরতে হয়নি। কৃষ্ণ, যিশু, রামকৃষ্ণ ও মা দুর্গা তাঁর ছবিতে বারবার এসেছে৷ বাড়িতে একটি বাঘছালের উপর বসে সামনে রাখা একটি ছোট ডেস্কে ছবি আঁকতেন৷ জল রং, তেল রং ও প্যাস্টেল- নানা মাধ্যমেই ছবি এঁকেছেন শিল্পী অন্নদা। তাছাড়া তিনিই প্রথম জল রংয়ের সঙ্গে রবার সলিউশন ব্যবহার করে ছবি আঁকেন৷ শিল্পীর বিখ্যাত সব ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে ‘লর্ড গৌরাঙ্গ ট্রাভেলস’ (রেল পরিবহণের বিজ্ঞাপন), ‘কথা দাও”, ‘মনে রেখো”, ‘এদের দেখবে কে’ প্রভৃতি৷
মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালি ছিলেন শিল্পী অন্নদা মুন্সি৷ সেই ব্রিটিশ আমলেও ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই তিনি চিরকাল অফিস যেতেন৷ আর পাঁচজন দেশপ্রেমী বাঙালির মতোই দেশভাগের যন্ত্রণা তাঁর বুকেও বেজেছিল৷ তাঁর ছেলেবেলার দিনগুলো কেটেছে ভারতের স্বাধীনতা-যুদ্ধের উত্তাল আবহে,ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। তবু রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে জড়াননি কোনওদিন৷ তাঁর ভাইপো প্রয়াত নাগপুরবাসী নাট্যরসিক সুমিতকুমার মুন্সি এ-প্রসঙ্গে জানিয়েছেন,”বাঙালির হৃদয়ের জ্যাঠামণির বুকে বিঁধত৷ দেশভাগের প্রসঙ্গ এলেই খুব বিচলিত হয়ে পড়তেন৷ স্বাধীন ভারতের স্বার্থপর নেতাদের মিমিক্রি করে খুব হাসাতেন৷ যে কোনও লোকের নকল করায় বিশেষ পারদৰ্শী ছিলেন জ্যাঠামণি৷”
অন্নদা মুন্সির জীবনে তুলি-কালির উল্টোপিঠে ছিল বাদ্য। তার সংগীতবোধের জন্ম ছোটবেলাতেই৷ একদিকে ছিল তাঁর রবীন্দ্রসংগীতে অনুরাগ, অন্যদিকে ধ্রুপদী পশ্চিমী সংগীতের সিম্ফনির উপর ছিল অসামান্য দখল৷ বেহালা,পিয়ানো,হারমোনিয়াম,তবলা,সেতার,বাঁশি ভালই বাজাতে পারতেন৷ তাঁর পাইকপাড়ার বাড়িতে ভারতবিখ্যাত সব শিল্পীরা আসতেন৷ মুস্তাক আলি খাঁ,বিলায়েত খাঁ,পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়,উস্তাদ বাহাদুর খাঁ,নিতাই বসু প্রমুখ দিকপালদের সমাবেশে বাড়ির ঘরোয়া আসর গমগম করত৷ এই বাড়ির নামকরণ করা হয়েছিল ‘স্বর্গরাজা’। এখানে আসতেন নজরুল, তারাশঙ্কর, গৌরকিশোর ঘোষ, সজনীকান্ত দাস৷
‘ক্রুশবিদ্ধ ভারত’নামে একটি বইও লিখেছিলেন অন্নদা মুন্সি৷ ধর্ম সম্পর্কে তাঁর এক নিজস্ব জীবনবোধ ছিল৷ তিনি বলতেন,ধর্মচ্যুত হওয়ার ফলেই আজকের মানুষ আত্মবিস্মৃত৷ আর তাই এত হিংসা ও হতাশার বাড়বাড়ন্ত৷ কর্মসূত্রে বস্বেতে থাকাকালীন ডিএলও কোম্পানি থেকে কয়েকটি গানের রেকর্ডও বের করেছিলেন তিনি৷ তাঁর তৃতীয় সন্তান সুমিত্রজিৎ (ম্যান্টো মুন্সি, অকালপ্রয়াত)তাঁর সংগীতানুরাগেরই উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন৷ আধুনিক বিজ্ঞাপনের জগতে অবিস্মরণীয় অবদানকে স্মরণ করে অন্নদা মুন্সিকে ‘ফাদার অফ ইন্ডিয়ান কমার্শিয়াল আর্ট, অভিধা দেওয়া হয়েছে৷ ১৯৮৫ সালের ১৯ জানুয়ারি রবিবার শেষরাতে এই মহান বাঙালি শিল্পী প্রয়াত হন৷ তবে তার আগেই বাঙালির শিল্প-প্রতিভাকে তিনি আরেকবার বিশ্বলোকের কাছে চিনিয়ে দিয়েছেন৷ উজ্জ্বল এই প্রতিভার আলোয় বাংলা আজও আলোকিত হয়ে রয়েছে৷
This post is also available in: English