
অগ্নিযুগের অগ্নিশিখা
রাজ চক্রবর্তী
অগ্নিযুগের নির্ভীক যুবক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ইতিহাসে বাঘা যতীন নামেই প্রসিদ্ধ। যুগান্তর দলের এই প্রধান বিপ্লবী তার আত্মত্যাগ, মর্যাদাবোধ ও জাতীয়তাবোধের আলোয় বাংলা তথা ভারতকে আজও আলোকিত করে রেখেছেন। শারীরিক শক্তির জন্য কম বয়সেই খ্যাতি রটেছিল তাঁর। একবার একটি ছুরি নিয়ে এক বাঘের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে জিতে তাঁর ‘বাঘা যতীন’ নাম হয়েছিল।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কয়াগ্রামে দুরন্ত বঙ্গসন্তান যতীন্দ্রর জন্ম ৭ ডিসেম্বর, ১৮৭৯ তারিখে। এই পৃথিবীতে তাঁর আয়ু ছিল মাত্র ৩৫ বছর। সেই ছোট্ট প্রাণটুকু দেশের জন্য বাজি রেখে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছেন। এ বছর তাঁর ১৪০তম জন্মজয়ন্তীতে তাকে আমরা সগর্বে স্মরণ করি।
বীর যতীন্দ্রর বাবা ছিলেন উমেশচন্দ্র। মা শরৎশশী ছিলেন স্বভাবকবি। যতীন্দ্রর জীবনে দেশসেবা ও বীরত্বের প্রেরণা জুগিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে তাঁর মা ছাড়াও ছিলেন গুরু স্বামী ভোলানন্দ গিরি, স্বামী বিবেকানন্দ, বড় মামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ। বিবেকানন্দের প্রেরণাতেই কলকাতায় শরীরচর্চার জন্য তাঁর অম্বু গুহর কুস্তির আখড়ায় যোগদান এবং কিছুকাল পরে কলকাতায় প্লেগ রোগের সময় সবান্ধবে সেবায় আত্মনিয়োগ। সে সময়ই গীতাপাঠ, ফুটবল খেলা এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য আধ্যাত্মিক বিকাশের চিন্তায় মনোযোগী হন।
সে সময় কলকাতায় টাইপরাইটারের সদ্য প্রচলন হয়েছে। কলেজ পড়ুয়া যতীন্দ্র স্টেনো টাইপিংয়ের ক্লাসে ভর্তি হলেন। ১৮৯৯ সালে কুড়ি বছরের যতীন্দ্র মজঃফরপুরে চলে যান। পাঁচ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হয়েছিল। এবার কলেরা রোগীর সেবা করতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে যতীন্দ্রর মা-ও চলে গেলেন পরলোকে ১৯০৩ সালে অরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলেন। সঙ্গে চলল গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোড়ার প্রশিক্ষণ। যোগ দিলেন অনুশীলন সমিতিতে।
১৯০৬ সালের শেষে যতীন সপরিবার দেওঘরে বাস করতে থাকেন। বারীণ ঘোষের সঙ্গে সেখানে একটি বোমার কারখানা গড়ে তোলেন। ইতিমধ্যে যতীনের বিবাহ ও দীক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। একটি শিশুপুত্র জন্মেছে এবং অকালে মারাও গিয়েছে (পরেঅবশ্য আরও দুই ছেলে ও একটি মেয়ে হয়েছে)। এই সময় বারীণ ঘোষের সঙ্গে মতবিরোধ হল। যতীন চলে গেলেন দার্জিলিং। ১৯০৮ সালে একদিন শিলিগুড়ি স্টেশনে অপমানের প্রতিবাদে চারজন ব্রিটিশ সামরিক অফিসারকে একাই পিটিয়ে চোয়াল ভেঙে দেন যতীন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিতে যতীন সাতজন বাঙালি মেধাবী ছাত্রকে বিদেশে পাঠান বিস্ফোরক প্রস্তুতি শেখার নির্দেশ দিয়ে। বিদেশের মানুষের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি আদায় করার দায়িত্বও তাদের দেওয়া হয়েছিল। এদিকে দেশে নানা সেবাকার্যের সুযোগে সংগ্রামের চেতনা তৈরিতে মন দিলেন যতীন। বাছাই করা কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে বাদা অঞ্চলে গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র চালনার তালিম দিতে লাগলেন। তাঁর পরিচালনায় কয়েকটি হত্যা ও ডাকাতির ঘটনায় ইংরেজ সরকারের মেরুদণ্ড কাঁপতে শুরু করেছিল।১৯১০ সালের জানুয়ারিতে গ্রেফতার হলেন যতীন।
ইতিমধ্যে জার্মানির সঙ্গে ভারতীয় বিপ্লবীরা ব্রিটিশ-বিরোধী যড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন। কাইজারের সঙ্গে অস্ত্রচুক্তি করে স্থির করেছিলেন ওয়াশিংটনের জার্মান রাষ্ট্রদূত সেই অস্ত্র জাহাজে ভারতে পাঠানোর দায়িত্ব নেবেন। এই সময় যতীন কারামুক্ত হয়ে গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন কলকাতায়। তারপর একদিন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে সোজা চলে গেলেন পৈতৃক ভিটে ঝিনাইদহে। কলকাতায় আরও দুটি ভয়ংকর ডাকাতি করে বিপ্লবীদের রসদ সংগ্রহ হল। একটি বিরাট অভুখানের জন্য নিপুণ হাতে ঘুঁটি সাজানো হতে লাগল। ক্রমে কলকাতার পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠল। যতীন তার পাঁচজন অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন উড়িষ্যার বালেশ্বরে। জার্মান অস্ত্ৰবোঝাই জাহাজ ওখানেই গোপনে আসার কথা। কিন্তু শেষপর্যন্ত খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অস্ত্র এসে পৌঁছল না। পেনাং-এর একটি সংবাদপত্রের কাটিং থেকে জাহাজ ধরা পড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে নিদারুণ হতাশ হয়ে পড়লেন যতীন। তবে ভেঙে না পড়ে সতীর্থদের গোপন ডেরায় গীতার ক্লাস করিয়ে চাঙ্গা রাখলেন। ব্রিটিশ পুলিশ এই অভ্যূখানের খবর পেয়ে মরিয়া তল্লাশি শুরু করেছে। যতীন এবার দৃঢ়স্বরে জানালেন, ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধ করেই মরবেন। তাতেই দেশ জাগবে। কয়েকদিন জঙ্গলে ঘুরে ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫ পৌঁছলেন বুড়িবালাম নদীর উপকণ্ঠে। অবিলম্বে পুলিশের সঙ্গে শুরু হল খণ্ডযুদ্ধ। চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে বিরাট পুলিশ ও সামরিকবাহিনী ঘিরে ফেলল বিপ্লবীদের। কলকাতার রডা কোম্পানি থেকে কেনা মাউজার পিস্তল নিয়ে দুঃসাহসী বিপ্লবীরা জঙ্গল আর পরিখার আড়াল থেকে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ লড়াই চালাতে লাগলেন। এমন যুদ্ধের কল্পনাও করতে পারেনি ব্রিটিশ। শেষ পর্যন্ত শহিদ হলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরি। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে অবসান হল সেই অসম যুদ্ধের। পরদিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করলেন গুরুতর জখম যতীন্দ্রনাথ। মারা যাওয়ার আগে রক্তবমি করে শেষ কথা বলে গেলেন—“এত রক্ত ছিল শরীরে! আমার সৌভাগ্য, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।”
যতীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাংলা তথা ভারতের কোটি কোটি সন্তান তাঁর মতো ভালবাসবে এই দেশকে। তারাই স্বাধীন করবে মাতৃভূমিকে। তাঁর মাতৃভূমি স্বাধীন হয়েছে। আমরা যেন এই বীর বাঙালির আত্মত্যাগকে কোনওদিন ভুলে না যাই। বাংলা এইসব বীর সন্তানের জন্য গর্বিত থাকবে চিরকাল।
This post is also available in: English